বিষয়:- কুরবানীর পশুর বিবরণ

মাসয়ালা (১) - কুরবানী পশু কয়েক প্রকার। যথাঃ উট, গরু, ছাগল। মহিষ গরুর মধ্যে গণ্য। অনুরূপ ভেড়া ও দুম্বা ছাগলের মধ্যে গণ্য। এই সমস্ত পশুর নর ও মাদাহ সবই কুরবানী করা জায়েজ। (আলমগিরী)
মাসয়ালা (২) – জংলি জানোয়ার যথা হরিণ, নীল গাই ইত্যাদি কুরবানী করা জায়েজ নয় (আলমগিরী)।
মাসয়ালা (৩) - জংলি পশু ও পালিত পশুর মিলনে বাচ্চা পয়দা হলে মাতার অবস্থা গ্রহণযোগ্য হবে। যথা হরিণ ও বকরীর মিলনে বাচ্চা পয়দা হলে কুরবানী জায়েজ হবে। কিন্ত বকরা ও হরিণীর মিলনে বাচ্চা পয়দা হলে কুরবানী জায়েজ হবেনা (আলমগিরী)।
মাসয়ালা (৪) – উট পাঁচ বৎসর, গরু দুই বৎসর, ছাগল একবৎসরের না হলে কুরবানী করা জায়েজ হবেনা। দুম্বা অথবা ভেড়ার ছয়মাসের বাচ্চা যদি খুব বড় হয় এবং দেখতে একবৎসর এর মনে হয়, তাহলে কুরবানী জায়েজ হবে। (দুররে মুখতার)
মাসয়ালা (৫) - ছাগলের মূল্য এবং মাংস যদি গরুর সাত অংশের একাংশের সমান হয়, তাহলে ছাগল কুরবানী করা উত্তম হবে। আর যদি গরুর সপ্তমাংশ ছাগলের থেকে বেশী মাংস হয়, তাহলে গরু উত্তম হবে। যখন দুয়ের মাংস ও মূল্য সমান হবে, তখন যার মাংস ভালো হবে, তার কুরবানী করা উত্তম হবে। যদি মাংসের পরিমাণ কমবেশি হয়, তাহলে যার মাংস বেশি হবে তার কুরবানী উত্তম হবে। অনুরূপ মাংস ও মূল্য সমান হলে দুম্বা অপেক্ষা দুম্বী, বকরী (ধাড়ী) অপেক্ষা খাসী, উট অপেক্ষা উটনী ও বলদ অপেক্ষা গাভী কুরবানী করা উত্তম হবে
কুরবানীর পশুর নিখুঁত হওয়া উচিত
মাসয়ালা (১) - কুরবানীর পশু নিখুঁত হতে হবে। সামান্য খুঁত থাকলে কুরবানী জায়েজ হবে, তবে মাকরুহ হবে। খুব বেশি খুঁত থাকলে আদৌ কুরবানী হবেনা। জন্ম হতে শিং না থাকলে কুরবানী জায়েজ হবে। শিং সামান্য ভেঙে গেলে জায়েজ হবে। কিন্তু শিং গোড়া হতে ভেঙে গেলে জায়েজ হবেনা। যদি পশু পাগল হয়ে যায় এবং চড়ে পানাহার করা ত্যাগ করে থাকে, তাহলে জায়েজ হবেনা। এই প্রকার পাগলামি না হলে জায়েজ হবে (রদ্দুল মুহতার, আলমগিরী)।
মাসয়ালা (২) – যে পশুর অণ্ডকোষ ও লিঙ্গ কেটে নেওয়া হয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েজ হবে। অনুরূপ যে পশুর অত্যন্ত বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছে যে, বাচ্চা হবেনা, যে পশুর দাগ দেয়া হয়েছে, যে পশুর দুধ দেয়া বন্ধ করেছে, এইসমস্ত পশুর কুরবানী জায়েজ। যে পশুর চুলকানি হয়েছে কিন্ত খুব মোটাতাজা রয়েছে, তার কুরবানী জায়েজ। যে পশু অত্যন্ত ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে এবং হাড়ের মগজ পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে এই প্রকার পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। (আলমগিরি ও রদ্দুলমুহতার)।
মাসয়ালা (৩) - অন্ধ পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। অনুরূপ কানা পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। যে ল্যাংড়া পশু হেঁটে কুরবানীর স্থানে যেতে না পারে, সে পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। অনুরূপ খুব অসুস্থ পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। যে পশুর কান অথবা লেজ একতৃতীয়াংশর বেশি অথবা তার কম কেটে গেছে তার দ্বারা কুরবানী জায়েজ হবে। যদি জন্ম হতে কান না থাকে, তাহলে কুরবানী জায়েজ হবেনা। কান ছোটো হলে জায়েজ হবে। (হিদায়া ও আলমগিরী)
মাসয়ালা (৪) – যে পশু একতৃতীয়াংশর বেশি দৃষ্টিহীন হয়ে গিয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। দু’চক্ষুর জ্যোতি কম হলে পরীক্ষা করা সহজে সম্ভব। একটি চোখের জ্যোতি কম হলে পরীক্ষা করার নিয়মঃ - পশুটির দুয়েকদিন আহার বন্ধ করে দিবে। তারপর খারাপ চক্ষুটি বন্ধ করে দিবে এবং ভালো চক্ষুটি খুলে রাখবে। বহু দূরে খাদ্য রেখে দিবে, যাতে পশুটি তা দেখতে না পায়। তারপর খাদ্য পশুর দিকে নিকটবর্তী করবে। যেখান থেকে পশু খাদ্য দেখতে পাবে সেখানে চিহ্ন করে রাখবে। এবার ভালো চক্ষুটি বন্ধ করবে এবং খারাপটি খুলে দিবে। তারপর খাদ্য ধীরেধীরে পশুর নিকটে আনতে থাকবে। যেখান থেকে দেখতে পাবে, সেখানে চিহ্ন করে রাখবে। এবার দুইটির স্থান মেপে দেখবে। যদি এইস্থানটি প্রথমস্থানের একতৃতীয়াংশ হয় তাহলে চক্ষুর জ্যোতি একতৃতীয়াংশ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর যদি অর্ধেক হয় তাহলে অর্ধেক নষ্ট হয়ে গিয়েছে। (হিদায়া)
মাসয়ালা (৫) - যে পশুর দাঁত নেই অথবা যার থানকাটা অথবা শুকিয়ে গিয়েছে সে পশুর কুরবানী জায়েজ নয়। ছাগলের একটি থান শুকিয়ে গেলে কুরবানী জায়েজ হবে। গরু ও মহিষের দুইটি থান শুকিয়ে গেলে কুরবানী নাজায়েজ হবে। নাককাটা পশু অথবা ঔষধের দ্বারা যে পশুর দুধ শুকিয়ে দেয়া হয়েছে অথবা দুই লিঙ্গ বিশিষ্ট হিজড়া পশু অথবা যে পশু অত্যন্ত পেশাব ও পায়খানা খায়, সে পশুর কুরবানী জায়েজ নয় (দুররে মুখতার)।
মাসয়ালা (৬) – ভেড়া অথবা দুম্বার পশম কেটে নিলে কুরবানী জায়েজ হবে। যে পশুর একটি পা কেটে নেওয়া হয়েছে তার কুরবানী জায়েজ নয়। (আলমগিরী)
মাসয়ালা (৭) – পশু ক্রয় করার সময় এমন কোনো দোষ ছিলোনা, যাতে কুরবানী নাজায়েজ হয়ে যায়। কিন্ত পরে পশুর মধ্যে ঐপ্রকার দোষ পাওয়া গিয়েছে। এখন ক্রেতা যদি মালেকে নিসাব (ধনীব্যক্তি) হয়, তাহলে অন্য পশু কুরবানী করবে। ক্রেতা মালিকে নিসাব নাহলে ঐ দোষযুক্ত পশুটি কুরবানী করবে। যদি কোনো গরীব মানুষ কুরবানী মান্নত করে থাকে এবং নির্দোষ পশু ক্রয় করে থাকে, পরে পশুর মধ্যে দোষ পাওয়া গেলে অন্য পশু কুরবানী করতে হবে। (হিদায়া, রদ্দুল মুহতার)
মাসয়ালা (৮) - গরীব মানুষ এমন দোষযুক্ত পশু ক্রয় করেছে, যার কুরবানী জায়েজ নয়। যদি কুরবানীর দিন পর্যন্ত এপ্রকার দোষ থেকে যায় তাহলে গরীব তার কুরবানী করতে পারবে। যদি কোনো ধনীমানুষ দোষযুক্ত পশু ক্রয় করে থাকে এবং কুরবানী দিনপর্যন্ত ঐ প্রকার দোষ থেকে যায়, তাহলে ধনীর জন্য তার কুরবানী জায়েজ হবেনা। দোষযুক্ত পশু ক্রয় করার পর কুরবানী করার পূর্বে যদি পশু নির্দোষ হয়ে যায়, তাহলে গরীব ও ধনী উভয়ের জন্য কুরবানী জায়েজ হবে (দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার)।
মাসয়ালা (৯) - যদি কোনো নির্দোষ পশু কুরবানী করার সময় লাফালাফি করার কারণে দোষযুক্ত হয়ে যায়, তাহলে তার কুরবানী জায়েজ হবে (রদ্দুল মুহতার)।
মাসয়ালা (১০) - কুরবানীর পশু মারা গেলে ধনী ব্যক্তির জন্য অন্য পশু কুরবানী করা ওয়াজিব। কিন্ত গরীবের জন্য ওয়াজিব নয় (দুররে মুখতার)।
মাসয়ালা (১১) – ধনী ব্যক্তির কুরবানীর পশু হারিয়ে গিয়েছে অথবা চুরি হয়ে যাবার পর পুনরায় পশু ক্রয় করার পর পশুটি পাওয়া গেলে দুইটির মধ্যে যেকোনো একটি কুরবানী করতে পারে। কিন্ত এই অবস্থা গরীবের হলে দুইটির কুরবানী করা ওয়াজিব হবে (দুররে মুখতার)।
মাসয়ালা (১২) – ধনী ব্যক্তির পশু হারিয়ে যাবার পর পুনরায় পশু ক্রয় করার পর যদি প্রথমটি পাওয়া যায়, তাহলে প্রথমটি কুরবানী করলে তার মূল্য দ্বিতীয়টির অপেক্ষা কম হলে কোনো দোষ নেই। যদি দ্বিতীয়টি কুরবানী করে থাকে এবং তার মূল্য প্রথমটি অপেক্ষা কম হয়, তাহলে যত টাকা কম হবে ততটাকা সদকা করতে হবে। অবশ্য দুইটি কুরবানী করে দিলে কোনো টাকা সাদকা করতে হবেনা
কুরবানীর পশুতে অংশ গ্রহণ
মাসয়ালা (১) – সাত ব্যক্তি মিলিত ভাবে কুরবানীর জন্য গরু ক্রয় করার পর তাদের কেউ একজন ইন্তেকাল করলে তার ওয়ারিসগণের অনুমতিতে কুরবানী করলে সবার পক্ষ হতে কুরবানী জায়েজ হয়ে যাবে। ওয়ারিসগণের বিনা অনুমতিতে করলে কারো কুরবানী জায়েজ হবে না (হিদায়া)।
মাসয়ালা (২) - অংশীদারদের মধ্যে কেহ কাফের থাকলে অথবা কারো উদ্দেশ্য কুরবানী না হয়ে কেবল মাংস খাওয়া হলে কারো কুরবানী হবে না (দুররে মুখতার ও রদ্দুল মুহতার)।
মাসয়ালা (৩) – অংশীদারদের মধ্যে একজনের নিয়ত বর্তমান সালের কুরবানী করা এবং অন্যদের উদ্দেশ্য গতসালের কুরবানী করা, এমতাবস্থায় যার উদ্দেশ্য বর্তমান সালের কুরবানী করা তার কুরবানী সহীহ হবে, এবং অন্যদের নিয়ত বাতিল হবার কারণে তাদের কুরবানী নফল হয়ে যাবে। যেহেতু গত বৎসরের কুরবানী বর্তমান সালে জায়েজ নয়, সেহেতু তাদের মাংস সাদকা করে দেয়া জরুরী। এমনকি যার কুরবানী সঠিক হয়েছে তার ও মাংস সাদকা করতে হবে (রদ্দুল মুহতার)।
মাসয়ালা (৪) - তিনব্যক্তি কুরবানীর পশু ক্রয় করেছেন। প্রথমব্যক্তি তিনশত টাকায়, দ্বিতীয়ব্যক্তি দুইশত টাকায়, তৃতীয়ব্যক্তি একশত টাকায়, কোনো প্রকারে তিনটি পশু মিলে গিয়েছে। কোনটি কার তা জানা সম্ভব হচ্ছেনা। এমতাবস্থায় তিনজন তিনটি পশু কুরবানী করে দিলে, যিনি তিনশত টাকা দিয়ে ক্রয় করে ছিলো, তার দুইশত টাকা সাদকা করে দিবে। যিনি দুইশত টাকায় ক্রয় করেছিলেন তিনি একশত টাকা সাদকা করে দিবেন। যিনি একশত টাকায় ক্রয় করে ছিলেন তার কিছু সাদকা করতে হবেনা। যদি তিনব্যক্তি একে অপরকে কুরবানী করার অনুমতি দিয়ে থাকে, তাহলে সবার কুরবানী হয়ে যাবে এবং কিছু সাদকা করতে হবেনা